সাংবাদিকতা ও মফঃস্বল সাংবাদিকতা
সাজ্জাদ আলম খান সজল
সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা, এই পেশায় টিকে থাকতে হলে সময়ের সাথে প্রতিনিয়ত নিজেকে আপডেট করতে হয়, সাথে অনেক পড়াশোনা থাকে কারণ একজন সাংবাদিকের সর্ব বিষয়ে জ্ঞান থাকা জরুরী। তবে আপনি অনেকভাবেই সাংবাদিক হতে পারেন, প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নিয়েও করতে পারেন, আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নিয়েও সাংবাদিকতা করতে পারেন। প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান বলতে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যম বিষয়ক চার বছরের স্নাতক এবং এক বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে সাংবাদিকতা শুরু করতে পারেন। আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান বা এই বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন না করেও সাংবাদিকতা পেশায় আসতে পারেন। যদিও বর্তমানে নাগরিক সাংবাদিকতা বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। নাগরিক সাংবাদিকতা হচ্ছে নাগরিক নিজেই তার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা তুলে ধরে।
এজন্য পেশা হিসেবে সাংবাদিকতার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট এর মাধ্যমেও সাংবাদিকতা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এখানে রুরাল জার্নালিস্ট ফাউন্ডেশন (আরজেএফ) বিশেষভাবে সহযোগীতা করে থাকে এইসব প্রশিক্ষনে হাতে-কলমে সাংবাদিকতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সাংবাদিকগণ তাৎপর্যপূর্ণ ইতিবাচক ভূমিকার স্বাক্ষর রেখেছেন। একটি দেশের সাংবাদিক, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, এমপি, মন্ত্রী যদি সৎ, যোগ্য, বাস্তববাদী হয় তবে যে কোন ধরনের উন্নতি করতে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের বাইরে মফস্বলের সাংবাদিকতাও পর্যাপ্ত বিস্তৃত হয়েছে এবং বিভিন্ন সমস্যা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকতা বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। মফস্বল শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘শহর বহির্ভূত স্থান’ বা ‘গ্রাম’। এই অর্থে মফস্বলের খবর মানে গ্রামের খবর কিন্তু বাস্তবে ঢাকার বাইরে শহর গ্রামগঞ্জ জনপদের খবরই মফস্বলের খবর- সুতরাং মফস্বল সাংবাদিকতা বলতে রাজধানী ঢাকার বাইরে বিভিন্ন মাত্রার সাংবাদিকদের বুঝানো হয়। বাংলাদেশের মফস্বলে মুদ্রণ গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকতাকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়। মফস্বল এলাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট সংবাদ কর্মীদের সাংবাদিকতা একভাগে চিহ্নিত হতে পারে। আর অন্য ভাগে ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় পর্যায়ের দৈনিক সাপ্তাহিক পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট সংবাদ কর্মীদের কার্যক্রমকে দ্বিতীয় ভাগে দেখানো যায়। বাংলাদেশে তীব্র আন্দোলন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালে সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনরায় চালু হওয়ার পর ঢাকা থেকে যেমন প্রচুর সংখ্যক জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে তেমনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও বিপুল সংখ্যক নতুন নতুন স্থানীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকাও প্রকাশিত হয়েছে, দেশে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের সংখ্যাও কিন্তু কম নয় বর্তমান অন লাইন পত্রিকা’র পত্রিকার সংখ্যাও অনেক, বিভিন্ন সরকারের আমলে দলীয় বিবেচনায় অনেক টিভি চ্যানেল হয়েছে। এ বিপুল সংখ্যক পত্রিকার দায়িত্ব পালনের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক সংবাদকর্মীর প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু এসব মফস্বল সংবাদকর্মীদের সমস্যা ও সম্ভাবনাও অনেক। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোতে মফস্বল ডেস্ক নামে একটি ডেস্ক আছে। এটা বার্তা বিভাগেরই অংশ। এ ডেস্কের একজন প্রধান থাকেন, তার সহযোগী থাকেন আরও কয়েকজন। ঢাকার বাইরে থেকে সংবাদদাতা, নিজস্ব প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর এ ডেস্কের সাংবাদিকরা প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন সাপেক্ষে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। ঢাকার বাইরে থেকে পাঠানো সংবাদগুলো গুরুত্ব অনুযায়ী সংবাদ পত্রের বিভিন্ন পাতায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া মফস্বলের সংবাদ প্রকাশের জন্য স্বতন্ত্র পাতা আছে প্রতিটি সংবাদপত্রে। তবে জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবে যারা কাজ করে থাকেন তাদের সকলের পরিচয় সাংবাদিক।
কিন্তু বিভেদ কেন? এ বিভেদের একটি গুরুত্বের কুফল এই যে, যারা উপজেলা, পৌরসভা, জেলা, বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন তাদের অনেকই কেন্দ্রীয় দপ্তরে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন তাদের তুলনায় নিজেদেরকে হীন ভাবেন। আবার কেন্দ্রীয় দপ্তরে এমন সব সাংবাদিক কাজ করেন যাদের মধ্যে এমন অনেক আছেন যারা নিজেদের মফস্বল সাংবাদিকদের চেয়ে শ্রেয়তর ভাবেন এবং এ নিয়ে অহংকার করে থাকেন। কোনো কোনো সময় মফস্বলের সাংবাদিকদের বিভিন্নভাবে হয়রানিও করে থাকেন। একজন সফল সাংবাদিক যে শিক্ষা দিক্ষা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, যোগ্যতা, পর্যবেক্ষণক্ষমতা, মেধা ও প্রতিভা থাকা দরকার তা একজন মফস্বল সাংবাদিকেরও থাকতে পারে, আবার কেন্দ্রীয় পরিদপ্তরে যারা কাজ করেন তাদের অনেকের মধ্যে সে সব যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, মেধা, প্রতিভা নাও থাকতে পারে। সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ব্যপারটি তার পারফরমেন্সের ওপর হওয়া উচিৎ। সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ এটা কোনো সময় ভেবে দেখেন না। উপজেলা পর্যায়ের সাংবাদিক, এমন কি জেলা পর্যায়ের কোনো কোনো সাংবাদিককে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকার বেতন ভাতা, সুযোগ সুবিধা দেন না। তবে তারা কোনো কোনো সময় অস্থায়ী নিয়োগ পত্র, নাম মাত্র একটি পরিচয়পত্র, পত্রিকার সৌজন্য কপি হাতে ধরিয়ে দিয়ে দায়িত্ব কর্তব্য শেষ করেন। তার পরেও কোনো কোনো সময় গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ না পাঠানো হলে ধমক খেতে হয়। সাংবাদিকতা হারানো ভয় থাকে। যারা উপজেলা পর্যায়ে সাংবাদিককে সার্বক্ষণিক পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাদের করুনা দশা। তাদের নুন আন্তে পান্তা ফুরায় অবস্থা। বর্তমান মানুষের চাহিদা অনেক কিন্তু সাংবাদিকের উপার্জন নেই, তাই এই পেশায় কেউ আসতে চাচ্ছেন না। পারিবারিক জীবনের বাস্তবতাকে মেনে ভদ্র মানুষরা অনেকেই এই পেশা বদল করেছেন। আর যারা সাংবাদিকতাকে নেশা বা দ্বিতীয় পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাদের কথা আলাদা। জীবনযাপনের জন্য সার্বক্ষণিক সাংবাদিকদের আরও অনেক কিছু করতে হয়। স্থানীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকার সাংবাদিকদের অবস্থা আরও করুন। বেতন ভাতা, সুযোগ সুবিধাবিহীন নিয়োগকৃত সাংবাদিক পরিচয়পত্র বহনকারী ওই সব সাংবাদিকরা পরিচয়পত্র ভাঙ্গিয়ে খেতে তারা অভ্যস্ত। ওই সব সাংবাদিকরা বাধ্য হয়ে হলুদ সাংবাদিকতার পথ বেছে নেয়। তারা সারাক্ষণ থানায় কর্মরত অসৎ পুলিশ, এএসআই, এসআই, ওসির পেছন পেছন ঘুর ঘুর করতে থাকে। কোনো ধর্ণাঢ্য ব্যক্তিকে অস্ত্র, হেরোইন, ফেনসিডিলসহ মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে চার্জসিট থেকে বাদ দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয় পুলিশ ও সাংবাদিক, রাজনৈতিক দলের নেতা পাতিনেতাদের মিলে ভাগ বাটোয়ারা করে খাওয়া এসব অবৈধ কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ে। কিছু অর্থিক সুবিধার জন্য। শুধু কি তাই মেয়র, এমপি, মন্ত্রীসহ জন-প্রতিনিধি ও মাদক সম্রাটদের সাথেও সখ্যতা রেখে অবৈধ পথে কালো টাকা আয় করতেও দ্বিধা করে না। ফলে জাতির বিবেক সাংবাদিকতা হয়ে যায় বিতর্কিত কলঙ্কিত। এত কিছুর পরেও সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ পত্রিকার প্রচার সংখ্যা বাড়ানো, বিজ্ঞাপনের জন্য বিনা বেতন ভাতায় মফস্বল এলাকায় সাংবাদিক নিয়োগ দিতে মরিয়া হয়ে উঠেন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তব সত্য।