রংপুরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের বদল ঘটছে কি বাস্তবতায়? প্রায় ৮ কোটি টাকার আমানত সর্বস্ব খুঁইয়েছে সঞ্চয় জমাদানকারী সদস্যরা। সঞ্চয়ের নামে টাকা উত্তোলনপূর্বক গাঁ ঢাকা দেয়ার ঘটনায় দিশেহারা প্রায় ২ হাজার হতদ্ররিদ্র সদস্য। বর্তমানে তাদের মধ্যে হতাশা আর চাপা কান্না বিরাজ করছে। অর্থ ফেরত পাওয়ার আশায় আমানতকারীদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। আর আখের গুছিয়ে বিলাসিতায় ব্যস্ত সমিতির সভাপতি। আমানতকারীদের অর্থকড়ি তছরূপ করার ঘটনায় কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো নিবন্ধন বাতিল করে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষও তাদের নিজেদের দায় এড়ানোর কৌশল বেঁছে নিয়েছে। ফলে আইনের রক্ষকের বিরুদ্ধেই খোর্দ আইনের বিধি-বিধান চরমভাবে লঙ্ঘন করছে বলে ভুক্তভোগী ও সচেতন মহল মনে করছেন।
জানা গেছে, রংপুরের বদরগঞ্জের শ্যামপুর বসন্তপুর এলাকার বাসিন্দা আহসানুল হক মডেল মাল্টিপারপাস কো-অপরেটিভ সোসাইটি লিঃ নামে সমিতি গঠন করে। বিগত ২০১১ সালের ১৬ মে জেলা সমবায় কার্যালয় থেকে নিবন্ধন সমিতিটির নিবন্ধন করে, যার রেজিঃ নং-৪৯, পরবর্তীতে বদরগঞ্জের শ্যামপুর, বসন্তপুরসহ আশপাশের এলাকা এবং মহানগরীর নজিরেরহাট, মাটিয়াপাড়া, কাশেম বাজার, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, বাবু খাঁ, গণেশপুর বিভিন্ন এলাকায় সমিতির প্রায় ২ হাজারেরও বেশি সংখ্যক সদস্য অর্ন্তভুক্ত করে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষজনের মাঝে উচ্চসুদের লোভ দেখিয়ে সঞ্চয় ও ডিপোজিট রাখেন বিভিন্নভাবে। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, সদস্যদের কাছে থাকা সঞ্চয় বইয়ে কারো ৫ হাজার, কারো ১০ হাজার হতে লক্ষাধিক এমনকি ২ লক্ষাধিক টাকারও বেশি ডিপোজিট রাখার ঘটনাও নজরে আসে। সমিতির সভাপতি তার নিজ এলাকায় বিলাসবহুল ৪ তলা বিশিষ্ট একটি ভবনও গড়ে তুলেছেন। ওই ভবনে সমিতির প্রধান কার্যালয় খুলে বসেন তিনি। গড়ে তোলা ভবনে সমিতির পুরো কার্যক্রম চালান সমিতির পরিচালনা কমিটি। এ ছাড়াও কর্তৃপক্ষ সমিতির কার্যক্রম নগরমুখি করে তুলতে আইনের প্রতি কোন তোয়াক্কা না করে নগরীর মধ্য গণেশপুর (ক্লাব মোড়ের) অদুরে ভাড়া নেয়া বাড়িতে সমিতির রংপুর ইউনিট-২ নামের শাখা অফিস চালুপূর্বক সাইনবোর্ড লাগিয়ে কার্যক্রম চালায়। রংপুর ইউনিট-২ চালু করার ক্ষেত্রে নিবন্ধকের পূর্বানুমোদন নেয়া হয়নি। আইনের বিধি লঙ্ঘন হলেও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাত কারণে নিরব থাকেন।
কোভিট-১৯ চলাকালে সদস্যদের অর্থ তোলার কার্যক্রম বন্ধ রাখে। এর পর কোভিট ১৯ পরবর্তী সময়কালে আর সঞ্চয়ের টাকা তোলা না হলেও ২ হাজার সদস্যের নিকট থেকে আদায় করা সঞ্চয় ও ডিপোজিটের প্রায় ৮ কোটি টাকা এবং মুনাফার অর্থ ফেরত দেয়নি পরিচালনা কমিটির সভাপতি আহসানুল হক। তখনই সমিতির সভাপতি আহসানুল হক এলাকা ছাড়েন বলে শ্যামপুর বসন্তপুর এলাকায় খবরটি বেশ চাউর হয়ে ওঠে । অনেক সদস্য টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় সভাপতির সাথে যোগাযোগ করে ধর্না দিয়েও কোন প্রতিকার পায়নি কেউ। শুধু সদস্যদের মাঝে সুকৌশলে বিভিন্ন সময় বেঁধে দিয়ে আসছেন টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে। আদৌ কি সদস্যরা স্ব-স্ব সঞ্চয় ও সঞ্চয়ের অর্থ ফেরত পাবে? না-কি তাদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে, আমানতকারিদের? অপরদিকে আইনের বিধি-বিধান অনুযায়ী মডেল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ এর অবসায়ন না করে উল্টো কার্যক্রম না চালানোর অভিযোগে চলতি বছরের ৮ মে জেলা সমবায় কর্মকর্তা আব্দুস সবুর নিবন্ধন বাতিল করেন। ক্ষুদ্র সঞ্চয় আদায় করার নিয়ম থাকলেও আইন অমান্য করে সদস্য বাগিয়ে ও লোভ দেখিয়ে ডিপোজিটের নামে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা হয়েছে। সমবায় সমিতির মোড়কে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানো হলে আইনে অপরাধকারীর ৭ বছরের সাজার বিধান রয়েছে বলে বিজ্ঞ এক আইনজীবী মন্তব্য করেন।
রংপুরে কর্মরত প্রিন্ট ও ইলেক্টনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা সমিতির সদস্যদের কাছে জানতে চাইলে অনুসন্ধানে বিষয়টি ওঠে আসে। সাংবাদিকরা বদরগঞ্জ উপজেলা সমবায় অফিসার হোসনে আরা বেগমের কাছে সমিতিটির হাল নাগাদ তথ্য জানতে চাইলে তিনি জানান, জেলা সমবায় অফিস হতে প্রায় ১ বছর পূর্বে সমিতিটির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে, এর বেশি কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
সমিতির নিবন্ধন বাতিল হওয়ার বিষয়টিও সদস্যদের কাছে গোপন করে রাখেন সমিতির সভাপতি আহসানুল হক। নগরীর বিভিন্ন এলাকার সদস্যদের মাঝে সমিতির নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি জানাজানি হয়। বিধি মোতাবেক নিবন্ধন বাতিলের ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে আপীল শুনানীর আবেদন দাখিল করার বিধান থাকলেও আহসানুল হক তা করেননি। অবশেষে লোক দেখানোর জন্য গত ১৬ অক্টোবর সমবায় অধিদপ্তর রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ে আপিল শুনানীর আবেদন করেন আহসানুল হক।
এদিকে, সমবায় অধিদপ্তর রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-নিবন্ধক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মুহাঃ শাহীনুর ইসলাম গত ২২ অক্টোবর স্বাক্ষরিত পত্রে সমবায় সমিতি বিধিমালা, ২০০৪ (সংশোধিত, ২০২০) এর ১১৯, (৪) এর বিধি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আাপিল না করায় আবেদনটি আপিল মামলা হিসেবে গ্রহণযোগ্য ও নিষ্পত্তিযোগ্য নয় বলে পত্র দিয়েছেন। অপরদিকে, সমিতির নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি স্বীকার করে মডেল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ-এর পরিচালনা কমিটির সভাপতি আহসানুল হক বলেন, আমি আপীল আবেদন করেছি, আর সদস্যদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। অপরদিকে, বিগত ২০১৮ সালে সমিতিটির সর্বশেষ অডিট করা হয়েছে বলে জানান জেলা সমবায় কার্যালয়ের পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেন।
এ ব্যাপারে জেলা সমবায় কর্মকর্তা আব্দুস সবুর বলেন, সমিতিটির অবসায়ন করার ক্ষেত্রে অবসায়ক নিয়োগ করা হয় নাই। কেউ টাকা পাবে, এ ধরনের অভিযোগ আমার কাছে কেউ করেননি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হবে, তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হবে। এছাড়াও এই কর্মকর্তা জানান, বিগত ১২ মাস সমিতির কোন কার্যক্রম না চালানোর অভিযোগে বদরগঞ্জ উপজেলা সমবায় অফিসারই সমিতির নিবন্ধন বাতিলের প্রস্তাব করেছেন। সেই প্রস্তাবের আলোকে সমিতির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এ